খুলনা, বাংলাদেশ | ১৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১লা জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Breaking News

  ইন্টার মিলানকে ৫-০ গোলে উড়িয়ে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের চ্যাম্পিয়ন হয়েছে পিএসজি
মোংলায় চীনাদের বিয়ের হিড়িক

বাংলাদেশী তরুনীকে বউ করে ফেরা হলো না স্বদেশ

মোংলা প্রতিনিধি

বাংলাদেশী তরুনীকে বিয়ে করে ঘর বাঁধার স্বপ্ন পূরণ হলো না চীনা যুবকের। হান কিংগু (৩২) নামের এ যুবক বউ নিয়ে স্বদেশে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও বাড়ি ফেরা হলো না তার। বাংলাদেশের মাটিতেই শেষ সমাধি হয়েছে হাজার মাইল দূরের এ চীনা যুবকের। বিয়ের মেহেদি ও রং শুকাতে না শুকাতেই স্বামী (চীনা যুবককে) হারানোর বেদনায় মুর্ছা খাচ্ছেন মোংলা পৌর শহরের কলেজ রোডের বাসিন্দা কাজল আক্তার (২০)। তার দাবি- মোটা অংকের চাঁদা না পেয়ে দালাল চক্র পরিকল্পিতভাবে তার সদ্য বিবাহিত স্বামী চীনা যুবককে হত্যা করে দুর্ঘটনা বলে প্রচারনা ও ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।

ভীনদেশী (বাংলাদেশী) নতুন বউয়ের অপেক্ষায় থাকা তার চীনা পরিবার সন্তানের জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পাশে দাঁড়ালেও তাকে আর বাঁচাতে পারেনি। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে ছেলের মরাদেহ দাফন করে চীনে ফিরে গেছেন তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোংলা পৌর শহরের কলেজ রোড় এলাকার বাসিন্দা দালাল জোহন হালদারের মাধ্যমে চীনের হেনা প্রদেশের বাসিন্দা হান কিংগু (২৫) বাংলাদেশে আসেন। তার বাড়ি চীনের হেনান প্রদেশের ঝংমু কাউন্টি ও হানসি শহরের জিয়াগুহান গ্রামে। বাবা হান সিনহে পেশায় একজন ব্যবসায়ী। দু’কন্যা ও এক পুত্র সন্তান তার। তিন সন্তানের মধ্যে হান কিংগু সকলের ছোট ও একমাত্র পুত্র। পরিবারের কাছে তার আবদার ছিল বাংলাদেশে বেড়াতে আসা। পরিবারও আপত্তি করেনি, এক মাসের ভিসা নিয়ে গত ১৫ এপ্রিল বাংলাদেশে বেড়াতে আসেন।

পূর্বের লিংকে এ চীনা যুবক প্রথমে (মোংলায় বাসিন্দা) দালাল জোহন হালদারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকা শাহাজালাল আর্ন্তজাতিক বিমান বন্দরে। পরে তার মধ্যস্থতায় চীনা যুবক বাগেরহাটের মোংলায় আসেন। এখানে মোংলা পৌর শহরের বাসিন্দা ভ্যান চালক ইব্রাহিমের মেয়ে কাজল আক্তারকে বিয়ে করতে সম্মত হয়। ধর্মান্তরিত হয়ে (মুসলিম) গত ১৭এপ্রিল ঢাকায় তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। পরে চীনা যুবক স্ত্রী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে মোংলায় শ্বশুর বাড়িতে অবস্থান করেন। বেশ ভালই কাটছিল ভীনদেশী এ তরুন-তরুনীর আবেগ আপ্লুত জীবন। বিয়ের দু’সপ্তাহ পার না হতেই কাজল আক্তারের ভ্যান চালক বাবার কাছে ৫ লাখ টাকা দাবি করে বিয়ের দালাল জোহন। নয়তো ভীনদেশী যুবকের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের হুমকি দেয়া হয়। আর এ নিয়ে কানাঘুষার মধ্যে এ ঘটনা চীনা যুবকের কানে পৌছায়।

চীনা যুবক সদ্য বিবাহীত স্ত্রী ও তার পরিবারকে জানায়, এ বিয়ে বাবদ দালাল তার কাছেও ৫ লাখ টাকা দাবি করেছে। অগ্রিম নিয়েছেন ৫০ হাজার টাকা। বাকী টাকা পরবর্তীতে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে চীনা যুবক। দালালের পরামর্শে প্রথমে অর্থ লেনদেনের বিষয়টি চীনা যুবক গোপন রাখে স্ত্রী কাজলের পরিবারের কাছে। একপর্যায় চীনা যুবক ও তার সদ্য বিবাহীত স্ত্রীর পরিবারের কাছে জানাজানি হয় অর্থ লেনদেনের বিষয়টি। এনিয়ে দালাল জোহন হালদার ও তরুনী কাজলের পরিবারের মধ্যে বাকবিতন্ডা ও মনমালিন্য হয়।

এ অবস্থার মধ্যে সদ্য বিবাহীত স্ত্রী কাজল আক্তারকে সঙ্গে নিয়ে নিজ দেশে ফেরার আগ্রহে নিজের ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য গত ৬ মে চীনা যুবক দালাল জোহান হালদারকে নিয়ে ঢাকায় যান। ঐদিন সকালে মোংলা থেকে ঢাকায় পৌঁছে ভিসা প্রক্রিয়ার প্রাথমিক শেষ করে শ্বশুর বাড়ি মোংলায় ফেরার কথা ছিল তার। ঢাকায় অবস্থানকালে চায়না থেকে ব্যবসায়ী বাবার পাঠানো ৩ লাখ টাকা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে চীনা যুবক হান কিংগু। ঐদিন দুপুরে স্ত্রী কাজল আক্তারের সঙ্গে ফোনে এমন কথা হয় তার। কিন্তু বিকেল গড়াতে দালাল জোহন ভীনদেশী যুবকের সঙ্গে শুরু করে নানা নাটকীয়তা। পরিবহনের গাড়ি না পাওয়ার অজুহাতে কালক্ষেপন করে কখনও হোটেলে, আবার কখনও দালালের নিজস্ব আত্মীয় বাড়িতে রাত যাপনের কথা বলা হয় তাকে। রাত সাড়ে ৮টায় বাইরে রাতের খাওয়া শেষে জোহন হালদার তাকে নিয়ে ঢাকার সোনারগাও কাঁচপুর কবরস্থান রোড় এলাকার জনৈক আশরাফ মাস্টারের ভাড়াটিয়া (জোহনের শালিকা) সুনিতার হালদারের বাসায় ওঠেন।

আধো-আধো বাংলায় কথা বলতে পারা চীনা যুবক এ বিষয় নিশ্চিত করে তার বউ কাজলকে। ওই দিন রাত ১১টায় কাজল হোয়াটসঅ্যাপে স্বামী চীনা যুবককে ভিডিও ফোনও করে। কথা শেষে ঘুমিয়ে পড়ে কাজল আক্তার। পরদিন (৭মে) ভোর সাড়ে ৫টায় সোনারগাঁও থানা পুলিশ কাঁচপুর নয়াবাড়ি ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে চীনা যুবককে। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে প্রথমে তাকে দি বারকাহ্ লিঃ ও মনপুর হাসপাতালে নেয়া হয়। পরবর্তীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে গুলশান ইউনাইটেট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এক পর্যায় চীনা দূতাবাসসহ পরিবারের কাছে খবর পৌঁছায়। নিকট আত্মীয় ও চীনা দূতাবাসের মাধ্যমে খবর পেয়ে হাসপাতালে পৌঁছায় মোংলার তরুনী কাজল ও তার পরিবার। পুলিশ ও পথচারীদের সহায়তায় উদ্ধার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকা চীনা যুবকের সন্ধানে ও তাকে সনাক্ত করে কাজল এবং তার পরিবার। পরে চীনা দূতাবাস ও কাজলের ফোন কল পেয়ে চায়না থেকে ৮মে ছুটে আসে তার বাবা। আর ১২ মে দু’বোন বাংলাদেশে আসেন। হাসপাতালে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষনে থাকা সন্তান তখন কোমায় হান কিংগু। এখানে চিকিৎসাধিন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। চীনা দূতাবাসের মধ্যস্থায় তাকে দাফন করা হয় উত্তরার একটি কবরস্থানে।

চীনা যুবকের স্ত্রী মোংলার কাজল আক্তার জানান, জোহন হালদালের শালিকা সুনীতা হালদার পরিকল্পিতভাবে স্বামী চীনা যুবককে হত্যা করেছে। যা তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে বলে দাবি কাজলের পরিবারের। এ ঘটনায় গত ১৯মে নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁও থানায় অজ্ঞাত নামা আসামি উল্লেখ করে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন কাজল আক্তার।

এ বিষয়ে মোংলার জোহন হালদার বলেন, চীনা যুবক তার সঙ্গে ভিসার মেয়ার বৃদ্ধির জন্য ঢাকায় গিয়েছিলেন। আর রাতে তার শালিকা সুনীতার ভাড়া বাসায় অবস্থান করছিলেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে চীনা যুবক হান কিংগুকে বিছানা ও রুমে দেখতে না পেয়ে খোঁজাখুজি শুরু করেন বলে জানায় জোহন হালদার। তবে বিয়ের জন্য দালালি বাবদ অর্থ লেনদেনসহ চীনা যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় নিজের কোন সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করেন তিনি।

এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ মফিজ উদ্দিন বলেন, গত ৭মে সকালে সোনারগাঁও থানা পুলিশ কাঁচপুর নয়াবাড়ি ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কে গুরুতর আহত পড়ে থাকা অবস্থায় চীনা যুবক হান কিংগুকে উদ্ধার করে। তার মুখোমন্ডল ও মাথায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এ ঘটনায় একটি নিয়মিত মামলা হয়েছে, যা পুলিশ তদন্ত করছে।

উল্লেখ, মোংলার নারিকেলতলা গ্রামের বাসিন্দা জনৈক নারী মেরিনা হালদারের মাধ্যমে জোহন হালাদারের দুই কন্যা ও শালিকার মেয়ের চীনা নাগরিকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর থেকে (দু’কন্যা ও শালিকার মেয়ে) তারা চীনে অবস্থান করছেন। তাদের মাধ্যমে চীনা যুবকেরা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় এসে চুক্তি ভিত্তিক (কন্টাককে) বাংলাদেশী তরুনীদের বিয়ে করেছেন। মোংলা উপজেলায় অন্তত ১৫থেকে ২০জন চীনা যুবক এ প্রক্রিয়ায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন বলে জানা গেছে। এমন বিয়ের মাধ্যমে একাধিক চীনা যুবক বর্তমানে মোংলায় অবস্থান করছে। এ চক্র দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় অন্তত শতাধিক চীনা যুবক ও বাংলাদেশী (গরীব অসহায়) তরুনীর নিকাহ কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে।

খুলনা গেজেট/এমএনএস




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!